অষ্টগ্রাম প্রতিনিধি:
ভাটীর রাণী খ্যাত উপজেলা অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়ায় জমে উঠেছে ৯৩তম স্থানীয় হিন্দু ধর্মীয় উৎসব চৌদ্দমাদল।
আজ বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারী) ৪ঠা মাঘ অনুষ্ঠিত প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বাঙ্গালপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে আরম্ভ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এ মেলা।
সময়ের গতানুগতিক ধারায় শতাব্দীকাল ধরে চলে আসা এ মেলাকে ঘিরে হাওরের এ গ্রামীণ জনজীবনে নেমে আসে প্রাণ চাঞ্চল্য। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সব বয়সের, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মনে জাগ্রত হয় মেলার এক দারম্নণ ইমেজ। সকল পার্বনকে যেন হার মানায় আবহমান কাল ধরে চলে আসা এ চৌদ্দমাদল মেলা।
হাওর জনপদ অষ্টগ্রামের নিজস্ব ঐতিহ্য প্রস্ফুটিত হয় এ মেলাকে কেন্দ্র করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভেদাভেদ ভূলে পারস্পরিক প্রীতি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে হাওর বাসীর মাঝে। এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে। উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে সর্বত্র। দূর দূরান্ত্ম থেকে ঘরে ঘরে আত্মীয় স্বজন বেড়াতে আসে। এ যেন এক মহা মিলন, মহা উৎসবের ধুম পড়ে যায়। এবারও এর কমতি নেই।
চৌদ্দমাদল সেবাশ্রম সূত্রে জানা যায়-স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী চার সম্প্রদায়ের দানে পরিচালিত চৌদ্দমাদল সেবাশ্রমে অন্যান্য বারের মত এবারও তারকব্রহ্ম মহানাম কীর্তন ও লীলা কীর্তন অনুষ্ঠিত হবে।
চৌদ্দমাদল শুরম্নর ইতিহাস চমকপ্রদ, জনশ্রম্নতি আছে-১৩৩৭বঙ্গাব্দ (১৯৩৭খ্রি.) এর মাধামাঝি সময়ে বাঙ্গালপাড়ার প্রবীন ভক্ত অনুরাগী রাধাকান্ত্ম দেবনাথ, নদীয়ার চাদ রায়, রাইচরণ সাহা ও প্রকাশ চন্দ্র সাহা তীর্থ করার মানসে ভারত যাত্রা করেন। তীর্থ ভ্রমনের কোন এক পর্যায়ে তারা নবদ্বীপ নামক স্থানে একত্রিত হয়। সেখানে চৌদ্দমাদল নামক একটি ধর্মীয় উৎসব পালিত হতে দেখেন। এ উৎসব তাদের খুবই অনুপ্রাণিত করে এবং মনস্থির করেন বাড়ি পৌছে তারাও চৌদ্দমাদল উদযাপন করবেন। সেই থেকেই শুরম্ন হয় চৌদ্দমাদল উৎসব। তাছাড়া চৌদ্দমাদল কীর্তনে ১৪টি খোল ও বাদ্যযন্ত্র এবং ১৪ জোড়া করতাল লাগে ফলে এর নাম চৌদ্দমাদল হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। জানা যায়- পূর্বে প্রতি বছর ৪ঠা মাঘ অষ্টগ্রাম, চাতলপাড়, গোয়ালনগর, রামপুর, কাস্তুলের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভক্তগণ নিজ নিজ দল নিয়ে কীর্তন করতে করতে চৌদ্দমাদলে এসে জমায়েত হত। মধ্যরাত পর্যন্ত্ম কীর্তন চলত।
কীর্তন শেষে ভক্ত-আগন্তুকদের মাঝে খিচুড়ি, লাবরা, মিষ্টান্ন বিতরণ এবং ফলমূল লুট দেওয়া হত। বর্তমানে সেই আচার ঠিক থাকলে ও কালের বিবর্তনে অনুষ্ঠানের শ্রী বৃদ্ধি তথা আরও আকর্ষণীয় করতে কর্তৃপক্ষ দেশের স্বনামধন্য কীর্তনীয় দলকে বায়না করেন। দলগুলো প্রহরে প্রহরে নাম ও লীলা কীর্তন পরিবেশন করে থাকেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়- বাঙ্গালপাড়া নিবাসী জয়হরি দেবনাথ প্রথমে চৌদ্দমাদলের জন্য কিছু সম্পত্তি দান করেন। প্রথমে সেখানে একটি টিনের চালা নির্মাণ করে চৌদ্দমাদলের সূচনা করেন। পরবর্তীতে সেখানে নাথ মন্দির স্থাপন করা হয়। বর্তমানে সুদর্শন মন্দিরে পাথরের নির্মিত গৌর নিতাই মুর্তি রয়েছে এছাড়াও রয়েছে গৌর গবিন্দের মুর্তি।
মেলা উদযাপন কমিটি জানায়-চৌদ্দমাদলকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাঙ্গালপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে সাতদিন ব্যাপী এক গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ এ মেলা সামাজিক উৎসবে রূপলাভ করে। এ উৎসবের জন্য সারা বছরই মানুষ উৎসুখ থাকে এবং প্রহর গুণতে থাকে। ছেলে মেয়েরা মাটির তৈরী ব্যাংকে টাকা জমাতে থাকে মেলায় খরচ করবে বলে।
মেলায় ইটনা, মিঠামইন,অষ্টগ্রাম, নিকলী,কুলিয়ারচর, আজমীরীগঞ্জ,ব্রাহ্মণবাড়ীয়া,বাজিতপুরসহ আশে পাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় পাঁচশতাধিক দোকান দার এসে মিষ্টি, উখড়া, ফল, চটপটি, খেলনা,প্রসাধনী, জুতা, কাপড়, লোহা, কাঠের ফার্নিচার, তৈজসপত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি, গৃহস্থালীর বাহারী রকম দোকানের পসরা সাজিয়ে বসে।
কিশোরী-নববধূরা দল বেধে মেলায় এসে সারা বছরের ব্যবহার উপযোগী চুরি, লিপিস্টিক, ফিতা, পাথরের অলংকার, খেলনা ইত্যাদি কিনে নিয়ে যায়। মেলায় বাহারী আসবাবপত্রের পসরা ছাড়াও চিত্তবিনোদনের জন্য রয়েছে নাগর দোলা, নৌকা দোলা, পুতুল নাচসহ গ্রামীণ সংস্কৃতির বিভিন্ন আয়োজন।
Leave a Reply